বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলো হচ্ছে- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, পশুর, সাঙ্গু প্রভৃতি।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চিরচেনা ও পরিচিত বেশির ভাগ নদীর উৎপত্তি হিমালয়, তিব্বত, আসামের বরাক এবং হুসাই পাহাড়ে। এগুলো শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে।
পদ্মা : পদ্মা নদী ভারত ও ভারতের উত্তরবঙ্গে গঙ্গা এবং বাংলাদেশে পদ্মা নামে পরিচিত। এর উৎপত্তিস্থল মধ্য হিমালয়ের গাঙ্গোত্রী হিমবাহে। উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্য অতিক্রম করে গঙ্গা রাজশাহী জেলা দিয়েপদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এটি গোয়ালন্দের নিকট ব্রহ্মপুত্রের প্রধান ধারা যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। চাঁদপুরে এসে এ নদী মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে বরিশাল ও নোয়াখালী অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নদী গঙ্গা-পদ্মা বিধৌত অঞ্চলের আয়তন ৩৪,১৮৮ বর্গ কি.মি.। পশ্চিম থেকে পূর্বে নিম্নগঙ্গায় অসংখ্য শাখা নদীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ভাগীরথী, হুগলি, মাথাভাঙ্গা, ইছামতী, ভৈরব, কুমার, কপোতাক্ষ, নবগঙ্গা, চিত্রা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ ইত্যাদি ।
ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনা তিব্বতের মানস সরোবরে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি হয়েছে। আসাম হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় এটি প্রবেশ করেছে। ব্রহ্মপুত্রের প্রধান ধারাটি এক সময়ে ময়মনসিংহের মধ্য দিয়ে উত্তর-পশ্চিমদিক থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে আড়াআড়িভাবে প্রবাহিত হতো। কিন্তু ১৭৮৭ সালে সংঘটিত ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্রের তলদেশ উত্থিত হওয়ায় পানি ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যায় এবং নতুন স্রোতধারার একটি শাখা নদীর সৃষ্টি হয়। এই নতুন স্রোত ধারাটি যমুনা নামে পরিচিত হয়। এটি দক্ষিণে গোয়ালদ পর্যন্ত যমুনা নদী বলে পরিচিত। যমুনার শাখা নদী ধলেশ্বরী এবং ধলেশ্বরীর শাখা নদী- বুড়িগঙ্গা। ধরলা ও তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের উপনদী। করতোয়া ও আত্রাই হলো যমুনার উপনদী। ব্রহ্মপুত্রের দৈর্ঘ্য ২৮১৭ কি.মি.। এর অববাহিকার আয়তন ৫,৮০, ১৬০ বর্গ কি.মি. যার ৪৪,০৩০ বর্গ কি.মি. বাংলাদেশে অবস্থিত।
মেঘনা : আসামের বরাক নদী নাগা-মণিপুর অঞ্চলে উৎপত্তি হয়ে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই মিলিত ধারা সুনামগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জের কাছে কালনী নামে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। এটি ভৈরব বাজার অতিক্রম করে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের কাছে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার মিলিত জলধারাই মেঘনায় এসে যুক্ত হয়েছে। সেখান থেকে চাঁদপুরের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে বিস্তৃত মোহনার সৃষ্টি করেছে। এটি পতিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। মনু, তিতাস,গোমতী, বাউলাই মেঘনার শাখা নদী। বর্ষার সময় প্লাবন ও পলি মাটিতে মেঘনা বাংলাদেশের উর্বরতা বৃদ্ধি করে।
কর্ণফুলী : বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদী কর্ণফুলী। এর উৎপত্তিস্থল লুসাই পাহাড়ে। ৩২০ কি.মি. দৈর্ঘ্যের এ নদীটি চট্টগ্রাম শহরের খুব কাছ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। কর্ণফুলীর প্রধান উপনদী হচ্ছে কাপ্তাই,,হালদা, কাসালাং ও রাঙখিয়াং। বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম কর্ণফুলীর তীরে অবস্থিত। পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য এ নদীর গুরুত্ব অধিক।
তিস্তা নদী সিকিমের পার্বত্য অঞ্চলে উৎপত্তি হয়ে তিস্তা নদী ভারতের জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং-এর মধ্য দিয়ে নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদী ১৭৮৭ সালের প্রবল বন্যায় গতিপথ পরিবর্তন করে ব্রহ্মপুত্রের একটি পরিত্যক্ত গতিপথে প্রবাহিত হতে থাকে। গতিপথ পরিবর্তনের পূর্বে এটি গঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছিল। তিস্তা নদীর বর্তমান দৈর্ঘ্য ১৭৭ কি. মি. ও প্রস্থ ৩০০ থেকে ৫৫০ মিটার।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় তিস্তা নদীর ভূমিকা সর্বাধিক। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পটি ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে নির্মিত হয়। ব্যারেজটি ঐ অঞ্চলে পানি সংরক্ষণ, পানি নিষ্কাশন, পানি সেচ ও বন্যা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পশুর নদী : খুলনার দক্ষিণে ভৈরব বা রূপসা নদী। এটি আরও দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ত্রিকোনা ও দুবলা দ্বীপদ্বয়ের ডানদিক দিয়ে মংলা বন্দরের দক্ষিণে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। প্রায় ১৪২ কি. মি. দীর্ঘ ও ৪৬০ মিটার থেকে ২.৫ কি. মি প্রস্থ এই নদীর গভীরতা এত বেশি যে, সারা বছর সমুদ্রগামী জাহাজ এর মোহনা দিয়ে অনায়াসে মংলা সমুদ্র বন্দরে প্রবেশ করতে পারে। খুলনা-বরিশাল নৌপথ হিসেবে পশুর নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সাঙ্গু-ফেনী, নাফ, মাতামুহুরী : সাঙ্গু নদী উত্তর আরাকান পাহাড় থেকে নির্গত হয়ে বান্দরবান জেলার থানছি উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এটি ২৯৪ কি.মি. দীর্ঘ। পার্বত্য ত্রিপুরায় উৎপত্তি হয়ে ফেনী জেলায় প্রবেশ করেছে ফেনী নদী। সন্দ্বীপের উত্তরে ফেনী নদী বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্তে নাফ নদী অবস্থিত। এর মোহনা অত্যন্ত প্রশস্ত। এই নদী বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৬ কি. মি। অন্যদিকে লামার মাইভার পর্বতে মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি হয়েছে। নদীটি কক্সবাজার জেলার চকোরিয়ার পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ কি.মি.।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর উল্লিখিত নদীসমূহের প্রভাব অপরিসীম। সেচের পানি, শিল্পে ব্যবহৃত পানি ও জল বিদ্যুৎ শক্তির উৎস এসব নদী। তাছাড়া মাছের উৎসও হচ্ছে নদী। নদী আমাদের পরিবহন ও যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান মাধ্যম। জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধিতে এসব নদী পলি বহন করে আনে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য, পরিবহন ইত্যাদি বহুলাংশে নদীর ওপর নির্ভরশীল বলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। নদীর প্রবাহে বাধা, নদীতে শিল্প ও জলযানের বর্জ্য ফেলা, পয়ঃনিষ্কাশন প্রবাহ যুক্ত করা, নদী দখল প্রভৃতি কারণে আমাদের দেশের অনেক নদীর প্রবাহ দুর্বল হয়ে পড়ছে। নদীর পানি দূষিত হচ্ছে এবং নদীর নাব্য হারিয়ে যাচ্ছে। এসব নদী সংরক্ষণে আমাদের সকলকেই অধিক সচেতন হতে হবে।
নদ-নদী ও জনবসতির পারস্পরিক সম্পর্ক
প্রাচীন যুগ থেকে মানুষ নদ-নদীর তীরবর্তী সমতল ভূমিতে বসবাস শুরু করে। কেননা, নদ-নদী থেকে মানুষের প্রাত্যহিক ব্যবহার্য পানি পাওয়া নিশ্চিত থাকে। এছাড়া কৃষি কাজের জন্যে পানির জোগানও নদী থেকে দেওয়া সম্ভব। জীবনধারণের জন্য কৃষির পাশাপাশি মাছ শিকার ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। নদ-নদীই মানুষের খাদ্য ও রোজগারেরপ্রধান উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর সকল সভ্যতা ও জনবসতি গড়ে ওঠার পিছনে নদ-নদীর ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তীকালে জীবন-জীবিকার উন্নতিতেও নদ-নদীকে মানুষ ব্যবহার করেছে। পানির কারণেই মানুষ নদীর কাছাকাছি বসতি স্থাপন ও জীবিকা নির্বাহের উৎসের সন্ধান করেছে। ফলে মানুষের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছে। বর্তমানকালে এ সম্পর্ক আরও বহুমাত্রিক এবং নিবিড় হয়েছে।
নদ-নদীকে কেন্দ্র করে মানুষ খাদ্যোৎপাদন, মাছ শিকার, পণ্য পরিবহন, ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থায়ী বসতি হিসেবে গ্রাম এবং শহর গড়ে উঠেছে। নদীসমূহ পানি সম্পদে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে জনসংখ্যার কিতার সর্বাধিক ঘটেছে নদীগুলোর তীরে। ফলে অধিকাংশ শহর, গঞ্জ (বাণিজ্য) গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নদীর তীরে। এভাবে বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা, কর্ণফুলীর তীরে চট্টগ্রাম, শীতলক্ষ্যার তীরে নারায়ণগঞ্জ, সুরমার তীরে সিলেট, গোমতীর তীরে কুমিল্লা ইত্যাদি লক্ষ করা যায়।
শিল্প, কলকারখানা প্রতিষ্ঠাতেও নদ-নদীর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য আধুনিক সেচ প্রকল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও নদ-নদীকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। গঙ্গা-কপোতাক্ষ পরিকল্পনা থেকে দেশের কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষিজ জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এতে ঐ অঞ্চলের মানুষ কৃষি উৎপাদনে লাভবান হচ্ছে। কর্ণফুলী বহুমুখী পরিকল্পনা থেকে ৬৪৪ কি.মি. নৌ চলাচল করছে। ১০ লক্ষ একর জমিতে কৃষিজ ফলন হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই নামক স্থানে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এ বাঁধের ফলে ভয়াবহ বন্যা থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলকে মুক্ত রাখাও অনেকাংশে সম্ভব হয়েছে। তিস্তা বাঁধ থেকে রংপুর, বগুড়া ও দিনাজপুর অঞ্চলের মানুষ এখন সুবিধা ভোগ করছে। মেঘনা নদী থেকে পানি নিয়ে বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলায় চাষাবাদ উন্নত করা সম্ভব হচ্ছে। সারা দেশেই নদীর পানিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন কৃষি পরিকল্পনা এখন বিস্তৃত হচ্ছে। এর ফলে দেশের কৃষি অর্থনীতি দিন দিন উন্নত হচ্ছে। মানুষের কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নদীপথে লঞ্চ ও স্টিমার দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। পরিবহনের জন্যও নদী পথকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন নদী পথকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের আর একটি সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা উন্নত করা, সুস্বাস্থ্য রক্ষা করা, নির্মল বায়ু ও শহরগুলোর পানির ব্যবস্থা করাসহ জনজীবনকে গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে নদ-নদীর ভূমিকা দিন দিন বেড়েই চলেছে। উত্তরাঞ্চলে যেখানে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে সেখানে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, জনজীবন হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। সে কারণে নদীর নাব্য রক্ষার জন্যে জরুরি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের নগর ও গ্রামের জনজীবন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে দেশের সকল নদ-নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সে কারণেই দেশে এখন পরিবেশবাদীরা ‘নদী বাঁচাও' জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছেন।
বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে পানির অভাবের কারণ, প্রভাব ও সমাধানের পদক্ষেপ
পানির অভাবের কারণ
বাংলাদেশে অসংখ্য নদ, নদী, খাল, বিল ও হাওড় থাকার পরও বেশকিছু অঞ্চলে পানির অভাব তীব্র হচ্ছে। অঞ্চলভেদে পানির অভাবের কারণের পার্থক্য থাকলেও সাধারণ কতিপয় কারণ রয়েছে।
বাংলাদেশের নদীসমূহে উজান থেকে প্রচুর পানি আসে। এ পানিতে প্রচুর পলি থাকে। এসব পলি নদীর তলদেশে জমা পড়ে। দীর্ঘদিন এভাবে পলি জমা হয়ে বেশকিছু নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নদীগুলোতে চর পড়ে যাওয়ায়পানির প্রবাহ কমে গেছে। তাছাড়া অনেক নদ-নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উত্তর বঙ্গ ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহে এ ধরনের অসংখ্য নদী মৃত নদী হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে। নদীগুলোর সজীবতা রক্ষা করতে মাঝেমধ্যে তলদেশে জমাকৃত পলি খনন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে নদী খনন করার উদ্যোগ তেমন জোরদার নয়। ফলে অনেক নদীর পানি প্রবাহ ও নাব্য হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশের অনেক নদীর উৎপত্তি স্থল ভারতে। ভারতে বেশকিছু নদীতে বাঁধ দেওয়ায় বাংলাদেশের নদীগুলোতে শুদ্ধ মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে গেছে। এর ফলে এদেশের কোনো কোনো নদী, যেমন- তিস্তা, গঙ্গা, কপোতাক্ষ ইত্যাদি শুকিয়ে যাচ্ছে। ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। পদ্মাসহ উত্তরাঞ্চলের সব নদীতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির চরম সংকট দেখা দেয়। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্যের উপর পানির অপ্রতুলতার নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সেচসহ নানা কাজে কোনো কোনো নদী থেকে পাম্প দিয়ে প্রচুর পানি উত্তোলনের ফলে মূল নদীতেই পানি আশংকাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ফলে নদী তার স্বাভাবিক গতি ও রূপ হারাতে বাধ্য হয়। নিয়ম-নীতি না মেনে নদীর উপর দিয়ে যত্রতত্র ব্রিজ, কালভার্ট, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণের ফলে অনেক নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে গ্রীষ্ম ও শীতকালে নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে নদী ধীরে ধীরে নাব্য হারিয়ে ফেলছে। এর ফলে বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি ও জনজীবন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশের অনেক নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে কৃষি, বাণিজ্য, মৎস্য চাষ, যাতায়াত কম হয়ে যাচ্ছে। ফলে নদীর তীরে গড়ে ওঠা বসতির জীবন ও জীবিকার সন্ধানে তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে ও শীতকালে নদী শুকিয়ে গেলে মাছের অভাব দেখা দেয়। ফলে পর্যাপ্ত আমিষের অভাবে পুষ্টিহীনতা দেখা দিতে পারে। আবার বর্ষাকালে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির চাপে বাড়িঘর ভাঙতে পারে, মানুষজন পৈতৃক ভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হতে পারে।
নদীপ্রবাহ হারালে দীর্ঘদিন ধরে নদীকে কেন্দ্র করে যেসব পেশার মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে তাদের জীবনে অভাব-অনটন নতুনভাবে সৃষ্টি হতে পারে। নদীর তীরে যেসব গাছপালা, বাগানবাড়ি, সবুজ বৃক্ষের সমারোহ গড়ে উঠেছে সেগুলো পানির অভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাতে মানুষ, মাছ, পশু-পাখি ও গাছ-তরুলতার অস্তিত্ত্ব বিপন্ন হতে পারে। আমাদের এসব নদীকে বাঁচাতে হবে। এর জন্যে নদী নিয়মিত খনন করা, নদীর উপর অপ্রয়োজনীয় বাঁধ, পুল, কালভার্ট নির্মাণ না করা, পানির প্রবাহ ঠিক রাখা ও জলাধার নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে।
যাতায়াত, জলবিদ্যুৎ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নদীপথের ভূমিকা বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা, জলবিদ্যুৎ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নদীপথের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
যাতায়াত : নদীমাতৃক দেশে যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নদীগুলোই বহন করছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, সুরমা, কীর্তনখোলা, করতোয়া, তিতাস, কুশিয়ারা, মাতামুহূরী, আত্রাই, মধুমতী, পড়াই ইত্যাদি নদী যাত্রী পরিবহন সেবায় বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে। নদীপথকে সকলে আরামদায়ক পথ বলে বিবেচনা করে থাকে। এদেশে নদীপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮৩৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩৮৬৫ কিলোমিটার পথে বছরের সবসময় নৌ চলাচল করে থাকে। বাংলাদেশে নদীপথে নৌকা, লঞ্চ, ট্রলার, স্টিমার, নৌট্রাক ইত্যাদি পরিবহনে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদেরগন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হচ্ছে। দেশে সরকারি এবং বেসরকারি বেশকিছু সংস্থা এসব পরিবহনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ সবা। ১৯৫৮ সালে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ তৈরি করা হয়েছে। সংক্ষেপে এটিকে বিআইডব্লিউটিএ (BIWTA) বলা হয়। জনস্বার্থে এই সংস্থা নানা ধরনের যাত্রীবাহী জলযানের ব্যবস্থা করে থাকে। নদী পথে কিছু সংরক্ষণ খরচ ছাড়া তেমন কোনো নির্মাণ খরচ না থাকায় নদীপথে যাতায়াত খরচও অপেক্ষাকৃত কম।
জলবিদ্যুৎ : নদী ও জলপ্রপাতের পানির কো ব্যবহার করে টার্বাইন যন্ত্রের সাহায্যে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তাকে জলবিদ্যুৎ বলা হয়। এটি নবায়নযোগ্য শক্তি সম্পদ। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই নামক স্থানে কর্ণফুলী নদীতে নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে পাকিস্তান আমলে প্রথম জলবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা হয়। সব চেয়ে কম খরচে এ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। বর্তমান বিশ্বে তেল, গ্যাস বা পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহারের মাধ্যমে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তার উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। সেই তুলনায় জল বিদ্যুতের খরচ অনেক কম। সে কারণে দেশের নদীর পানি সম্পদ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য লাভজনক। তবে যে ধরনের পাহাড়ি নদী থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, সে রকম পাহাড় ও নদী দেশে বেশি নেই। ফলে বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ কম।
বাংলাদেশ নদী পথে যাতায়াত ব্যবস্থাঃ
বাণিজ্য বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌপথে দেশের মোট বাণিজ্যিক মালামালের ৭৫ শতাংশ আনা-নেওয়া করা হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নদীপথের বাণিজ্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। এক সময় আমাদের তেমন কোনো জাহাজ ছিল না। এখন বহুমুখী পণ্যবাহী জাহাজের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে প্রায় সব নদীপথেই সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে লক্ষ লক্ষ টন মালামাল পরিবহন করা হয়ে থাকে। ফলে সকল প্রকার অস্থিতিশীলতার মধ্যেও নির্বিঘ্নে জাহাজ ও নৌযানযোগে পণ্য পরিবহন করা যায়। বর্ষাকালে বেশিরভাগ পণ্যই নৌপথে পরিবহন করা হয়। তবে শুষ্ক মৌসুমে নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়ার কারণে কোনো কোনো নদীতে জাহাজ চলাচল সীমিত হয়ে আসছে। দেশের কৃষি, শিল্প ও মৎস্য সম্পদের বিকাশঘটাতে নৌপরিবহনের কোনো বিকল্প নেই। সকল সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে বাংলাদেশের নৌ বাণিজ্যকে গতিশীল করার জন্যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের নদীর সর্বোচ্চ ব্যবহার ঘটিয়ে বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবে।